একটু ইনবক্সটা চেক করবেন?

অনলাইনে বিভিন্ন কাজ করে বেশ ভালো পজিশনে আছেন এবং বিভিন্ন গ্রুপের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তির জন্যে খুব কমন প্রশ্ন এটা। এতে কেউ বিরক্ত হন, কেউ আনন্দিত হন।

আর কারও কোন ফিলিংস হয়না।

ক্যাটাগরি তিনটা, আর তিন ক্যাটাগরিরই ব্যাখ্যা আছে।

যিনি আনন্দিত হন, তিনি সবেমাত্র অন্যদের থেকে প্রশ্ন, হেল্প করার আবেদন পেতে শুরু করেছেন।

যে বিরক্ত হয়, সে বেশ অনেকদিন যাবত এগুলো দেখে আসছে। অনেককেই সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। কিন্তু এর বিনিময়ে অনেকের থেকে নানা কটু কথাও শুনতে হয়েছে থাকে।

আর যার কোন ফিলিংস হয়না, তার উপরোক্ত দুইটা সময় পার হয়ে গেছে। তিনি আনন্দিত হন না, বিরক্তও হননা। এগুলো এভয়েড করে যান।

দুনিয়ায় লেখার জন্যে এতো সুন্দর বিষয় থাকার পরেও এই বিষয় নিয়ে কেনো লিখছি, তা নিশ্চয়ই পাঠককে ভাবাচ্ছে? :mrgreen:

সত্যি বলতে নিজের কিছু কথা বলার জন্যেই এই আর্টিকেল লিখছি।

আমাদের দেশের মানুষের একটা ভালো দিক হচ্ছে, মোটামোটি সফল বা সফল হলেও অন্যের প্রতি সাহায্য করার মানসিকতা থাকে। একেবারে হারিয়ে যায়না। কিছু ব্যতিক্রম থাকেই, সেটা বাদ দিলাম।

বহির্বিশ্বের বড় বড় দেশের লোকজনকে একটু দেখলেই বুঝবেন, তারা তাদের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। সোশাল মিডিয়াতে আসার জন্যে, জনগণের সমস্যা শোনার জন্যে, তাদের উপকার করার জন্যে সময় তাদের নেই। আমরা বাঙ্গালি, আমাদের সময়ের মূল্য তাদের চাইতে অনেক কম। আমরা কাজ করি, আমরা সোশাল মিডিয়াতে সময় দেই।

কারণে-অকারণে ফেসবুকে বসে বসে মানুষকে হেল্প করার মানসিকতা রাখি।

আর সে কারণেই, মানুষ আমাদের প্রতি আস্থা রেখে তার সমস্যার কথা আমাদের জানায়। কিভাবে কি করবে জানতে চেয়ে ফেসবুকে মেসেজ দেয়। কেউবা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে ইমেইল করে।

সবাই আশায় থাকে, তার মেসেজটা দেখা হবে, তাকে যৌক্তিক উত্তর দেয়া হবে।

কারও আশা পূরণ হয়, কারো আশা ভাসা অবস্থায় থাকে।

যিনি ফিরতি রিপ্লাইতে সমাধান পান তার কাছে ঐ লোক খুবই ভালো। আর যিনি উত্তর পান না, তার কাছে ঐ লোক একজন বেয়াদপ, অসভ্য, ঠকবাজ এবং “ভাব বাইরা গেছে” টাইপ লোক।

তিনি ধরেই নেন, ঐ লোকের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় আছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার সময় আছে, গ্রুপে উত্তর দেয়ার সময় আছে, মানে আমার মেসেজ চেক করে আমাকে উত্তর দেয়ার সময়টাও তার থাকতে হবে। তিনি হয়তো ভুলে যান, অপর পাশের লোকটি কাস্টোমার সাপোর্ট না বা তিনি উত্তর দিতে বাধ্যও না।

কেউ তার মনের কষ্ট নিজের মধ্যেই রেখে দেন উত্তর না পেয়ে। কেউ বা দুই এক লাইন ডিকশনারি বহির্ভূত শব্দাদি দিয়ে জাত-গুষ্টি উদ্ধার করে দেন।

ইনবক্স চেক করার বিষয়ে যে ৩ ধরণের কথা আমি বলেছি, তার প্রতিটা স্টেজেই আমি ছিলাম। আমি জানি কোন সময়ে কেমন লেগেছে, কোন সময়ে কিভাবে কি করেছি।

সেটাই জানাতে চাই।

আমার ফ্রিল্যান্সিং শুরু ২০০৮-২০০৯ এর দিকে, সেসময় টেকটিউনসে লেখালেখি এবং মডারেটর সুবাদে মাঝে সাঝেই দুই একটা প্রশ্ন আসতো আমার কাছে। খুব আনন্দের ছিল সময়গুলো।

আমার এই আনন্দের সময় অনেক দীর্ঘ। দীর্ঘ হওয়ার পেছনে আমিই দায়ী, বেশিরভাগ মানুষের এই আনন্দের সময় ১-২ বছরের বেশি দীর্ঘায়িত হয়না সাধারণত।

এরপর একটা সময় পরে আনন্দিত-আর বিরক্ত দুইটার মাঝামাঝি অবস্থায় আমি আসলাম। প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ৪০-৫০ জনকে মেসেজে উত্তর দিতাম। দিনে ২-৩ ঘন্টা শুধু এর জন্যেই বরাদ্দ রাখতাম। কখনো সেটা আরও বেশিও হতো।

কিছু মানুষ আমার উপর আস্থা রেখে আমাকে প্রশ্ন করেছে; আমার কাছে তার সমস্যার কথা বলেছে।

তাকে আমি কিভাবে ফিরিয়ে দেই?

বিবেকে বাঁধে।

আমি সবার মন রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম। চেষ্টা করতাম যতো সাবলীলভাবে আর বিস্তারিত ভাবে যেন তাকে বুঝানো যায়।

প্রচুর টাইপ করতে হতো এর জন্যে আমাকে।

কম বেশি প্রতিদিনই আমার আঙ্গুল ব্যথা থাকতো।

এতো মেসেজের উত্তর দেয়া, গ্রুপে প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার দিনের অন্যতম রুটিন-ওয়ার্ক হয়ে উঠেছিল। শুধু পরীক্ষার সময়টুকু আমি একটু বিরতি নিতাম।

এরপর একটা সময় আসলো যখন আর সবার মেসেজের উত্তর দিয়ে শেষ করতে পারিনা। কারণ এখন আর আগের মতো ৪০-৫০টা না, এবার মেসেজের জন্যে প্রতিদিন ৬০-৭০-৮০ও হয়ে গেলো।

কোন এক অজানা কারণে মানুষ বিশ্বাস করে আমাকে মেসেজ দিয়েছে। সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে নিজের মধ্যে এক ধরণের অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করে।

আমি মানুষের উপর বিরক্ত না, আমি বিরক্ত নিজের উপর।

কেনো আমি পারছিনা, কেনো আমি পারবোনা।

আমার আশেপাশে যারা ছিলেন অনলাইন জগতের, যাদের সাথে আমার প্রায়শই চলাফেরা, তারা আমার এই অপরাধবোধের কথা জেনে থাকবেন।

মাঝে এই অপরাধবোধ এতো প্রবল হয়ে গেলো যে, আমি প্রচন্ড মানসিক প্রেশারের মধ্যে পরে গেলাম।

একাধিক জনকে জিজ্ঞেস করেছি, এই যে মানুষগুলো আমাকে মেসেজ দিচ্ছে, আমি উত্তর দিতে পারছিনা; এর জন্যে কি আমি গুনাহগার হবো?

আমি অনলাইনে আসা কম করে দিলাম।

কম্পিউটারের সামনে বসলেই উত্তর দিতে হতো, উত্তর দেয়ার চিন্তা মাথায় আসতো। আর সেটা আমাকে অনেক মানসিক যন্ত্রণা দিতো।

আমি মেসেজ দেখতাম না, এর জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দেখা হয়নি, বন্ধুদের মেসেজের উত্তর দেয়া হয়নি।

একটা বড় প্রগ্রামে কথা বলার সুযোগও মিস করেছি।

এরপর আমি মেসেজ দেখা খুবই কম করে দিলাম।

মাঝে মাঝে ইনবক্স ওপেন করে কিছু মেসেজ দেখতাম। আর বেশিরভাগ মেসেজই অপঠিত থাকতো। কারণ এখন মানসিক ভাবে প্রচন্ড প্রেশার মনে হয় আমার। আমি করতে পারিনা। একসময় পেরেছি। এখন সম্ভব হয়না আমার।

কেউ একটা সমস্যার কথা শেয়ার করলে সেটা সমাধান করে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। অন্যের সমস্যা সমাধানে নিজের মাথাতেও প্রচন্ড প্রেশার তৈরী হতো। এখন সেটা কেন যেন পারিনা।

তবে চেষ্টা করিনা এমন না। কম হলেও এখনো আমি মাঝে মাঝে মেসেজ দেখি। উত্তর দেই।

কিন্তু সবার মেসেজ চেক করা সম্ভব হয়ে উঠেনা। সময়ের অভাব, সুযোগ এর অভাব আর একটু স্বার্থপর মনোভাব।

তবে এই স্বার্থপরতা একটু ভিন্ন।

স্বার্থপর মনোভাবটা হলো নিজেকে আমি  মানসিক প্রেশার থেকে কিছুটা মুক্ত রাখতে চাই।

যাদেরকে কষ্ট দিয়েছি মেসেজ না দেখে বা উত্তর দিতে না পেরে, তাদেরকে বলছি – আমি লজ্জিত, দুঃখিত, ক্ষমাপ্রার্থী।

Ariful Islam Palash
 

বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। টুকটাক লেখালেখির পাশাপাশি বই পড়া, নতুন জিনিস জানার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে তার। ব্যবসার প্রতি মনের টান রয়েছে, ভবিষ্যতে দেশের অন্যতম একজন ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় নিজেকে। প্রয়োজনে ফেসবুকে পলাশ এর সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। :)